Ticker

6/recent/ticker-posts

সোলাইমানি হত্যা: টালমাটাল এক সপ্তাহ


নিহত কাশেম সোলাইমানি। ছবি: এএফপি
নতুন বছরের শুরুতে মার্কিন ড্রোন হামলায় ইরানের ক্ষমতাধর জেনারেল কাশেম সোলাইমানির হত্যা নিয়ে তোলপাড় বিশ্ব। জাতিসংঘ মহাসচিবের ভাষায়, বিশ্বের নতুন বছর শুরু হয়েছে অশান্তি দিয়ে। সোলাইমানিকে নির্ভুল নিশানায় হত্যা করে উচ্ছ্বসিত যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন। অন্যদিকে শোকে ভাসছে ইরান। দুই দেশের সম্পর্কে টান টান উত্তেজনার মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুদ্ধের আশঙ্কাও রয়েছে। সোলাইমানি হত্যার চরম প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে ইতিমধ্যে ইরাকে দুটি মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। এর আগে ট্রাম্প হুমকি দিয়েছিলেন, ইরান হামলা চালালে তিনি ইরানের ৫২টি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাবেন। সবশেষ দুই দেশের প্রেসিডেন্টের ভাষণে আরও হামলা চালানোর কোনো হুমকি না থাকলেও পরিস্থিতি ঠিক কোনদিকে যাবে, তা নিয়ে চলছে আলোচনা।

কাশেম সোলাইমানি হত্যার ৭ দিনে ঘটা নানা ঘটনা


৩ জানুয়ারি, শুক্রবার: স্থানীয় সময় মধ্যরাতে ইরাকের বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কাশেম সোলাইমানিকে বহনকারী গাড়িতে ড্রোন হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। শুরুতে ইরাকের সামরিক বাহিনী পরিচালিত বার্তা সংস্থা ও নিরাপত্তা মিডিয়া সেল আগুনে পুড়ে যাওয়া কয়েকটি গাড়ির ছবি প্রকাশ করে জানায়, কিছু লোক আহত হয়েছে। দিবাগত রাত দু্ইটার দিকে বিমানবন্দরে বিমান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। ইরাকের পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্সেস (পিএমএফ) এক বিবৃতিতে জানায়, ‘হামলায় দুই অতিথিসহ পাঁচ সদস্য নিহত হয়েছেন।’ এর কিছু পরই তারা জানায়, ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের কুদস ফোর্সের প্রধান কাশেম সোলাইমানি, পিএমএফের উপপ্রধান আবু মাহদি আল-মুহানদিসসহ কয়েকজন নিহত হয়েছেন। পরে ইরাক ও ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন পৃথকভাবে কাশেম সোলাইমানি নিহত হওয়ার তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে।
এ হামলার দায় স্বীকার করে মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর পেন্টাগন এক বিবৃতিতে জানায়, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে কাশেম সোলাইমানিকে হত্যা করা হয়েছে।


৪ জানুয়ারি, শনিবার: যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে বাগদাদে কাশেম সোলাইমানির শোক যাত্রায় লাখো মানুষ সমবেত হন। শহরের গ্রিন জোন যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস অবস্থিত, সে স্থান অতিক্রম করে শোকযাত্রা।
সোলাইমানি হত্যার ঘটনায় রেভল্যুশনারি গার্ডের জেনারেল গোলাম আলি আবুহামজেহ হুমকি দিয়ে বলেন, ইরানের নাগালের মধ্যে যেকোনো স্থানে মার্কিনিদের পেলে সাজা দেওয়া হবে।

সে ক্ষেত্রে তিনি হরমুজ প্রণালি দিয়ে মার্কিনি ও মার্কিন যুদ্ধজাহাজ চলাচলের বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, তাদের নাগালের মধ্যে ৩৫ টি মার্কিন লক্ষ্যবস্তু ও ইসরায়েলের তেল আবিব রয়েছে।

ট্রাম্প টুইটে ইরানকে হুঁশিয়ার করেন, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ৫২টি স্থাপনা হামলার লক্ষ্যবস্তু হিসেবে ঠিক করে রেখেছে। ইরান হামলা চালানে সেসব স্থানে ‘দ্রুত ও শক্তিশালী হামলা’ চালাবে যুক্তরাষ্ট্র। তবে এই মন্তব্য করে বিপাকে পড়েন ট্রাম্প। কারণ ঐতিহ্যবাহী স্থাপনায় হামলা জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক আইনে যুদ্ধাপরাধের শামিল।

৫ জানুয়ারি, রোববার: ইরাক থেকে সোলাইমানির মরদেহ ইরানের আহভাজ শহরে পাঠানো হয়। সোলাইমানির মরদেহ আসা উপলক্ষে শোকাহত লাখো মানুষের ঢল নামে আহভাজ শহরে।

ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ ট্রাম্পের ৫২ স্থাপনায় হামলার হুমকির পাল্টা জবাব দেন। তিনি এটাকে যুদ্ধাপরাধ বলে উল্লেখ করেন এবং ট্রাম্পের বক্তব্যের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) ঐতিহ্যবাহী স্থাপনায় হামলার তুলনা করেন।

ইরাকে দুটি মার্কিন ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইরান। ছবি: রয়টার্স
সোলাইমানি এবং আল-মুহানদিসের মরদেহ শনাক্তে পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার পর সোলাইমানির মরদেহ নিজের শহর কেরমানে সমাহিত করার সিদ্ধান্ত হয়। আর মুহানদিসের মরদেহ সমাহিত করার জন্য ইরাকের নাজাফ শহরে ফেরত পাঠানো হয়। ইরানি কর্তৃপক্ষ সোলাইমানির মরদেহ তেহরান ও পবিত্র নগর কোমে নেওয়ারও পরিকল্পনা করে।

ইরান দেশটিতে অবস্থানরত জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েক দেশের কূটনীতিকদের তলব করে। এদিকে উত্তেজনা কমাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) পররাষ্ট্রমন্ত্রী জারিফকে ব্রাসেলসে আমন্ত্রণ জানায়।
ইরাকের পার্লামেন্টে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশি সেনাদের ইরাক ছাড়তে বলে একটি প্রস্তাব পাস করে।
২০১৫ সালের আলোচিত পরমাণু চুক্তি থেকে সরে দাঁড়ানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে ইরানের উচ্চপদস্থ নেতারা বৈঠক করেন।

৬ জানুয়ারি, সোমবার: কাশেম সোলাইমানিকে হত্যার ঘটনায় জাতিসংঘে নিন্দা প্রস্তাব আনার ওপর জোর দেন জাতিসংঘে ইরাকের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মেদ হুসেইন বাহর।

জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল, ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ‘দুই পক্ষকেই সংযম প্রদর্শনের’ আহ্বান জানান।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস টু্ইটারে সতর্ক করে বলেন, এই শতকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের উত্তেজনা বিরাজ করছে। অশান্তি দিয়ে এই বিশ্বের নতুন বছর শুরু হয়েছে।

সৌদি আরবের উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী খালিদ বিন সালমান এবং মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও যুক্তরাষ্ট্রে এক বৈঠকে মিলিত হন।

মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপের জানান, ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের কোনো পরিকল্পনা নেই তাঁদের। এর আগে ইরাক থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার নিয়ে ইরাকে মার্কিন সামরিক টাস্ক ফোর্সের প্রধানের এক চিঠি নিয়ে বিভ্রান্তি হয়।
উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে ১১ জানুয়ারি বৈঠকের সিদ্ধান্ত হয়।
তেহরানে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির পরিচালনায় সোলাইমানির জানাজায় লাখো মানুষ অংশ নেয়।

৭ জানুয়ারি, মঙ্গলবার: নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বৃহস্পতিবারের বৈঠকে যোগ দেওয়ার জন্য মার্কিন ভিসার জন্য আবেদন করে পাননি ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ।

সোলাইমানির জন্মস্থান কেরমানে জানাজার সময় পদদলিত হয়ে অর্ধশতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। আহত হয় দুই শতাধিক মানুষ। জানাজায় ১০ লাখের বেশি মানুষ অংশ নেয় বলে ধারণা করা হয়। ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ রুহোল্লাহ খোমেনির জানাজার পর ইরানে আর কোনো জানাজায় এত মানুষের উপস্থিতির ঘটনা ঘটেনি। ১৯৮৯ সালে খোমেনির জানাজা হয়।

জার্মানি, কানাডা এবং পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটো ইরাকে মোতায়েন করা তাদের কিছু সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়।

পদদলিত হয়ে অর্ধশতাধিক মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় সোলাইমানিকে সমাহিত করা স্থগিত করা হয়।

ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। ছবি: রয়টার্স
ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। ছবি: রয়টার্স
৮ জানুয়ারি, বুধবার: কেরমান শহরে সোলাইমানিকে সমাহিত করা হয়।

ইরাকে আল-আসাদ ও ইরবিলে দুটি মার্কিন ঘাঁটি বরাবর ২২টি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে ইরান। এটাকে সোলাইমানি হত্যার ঘটনায় ‘চপেটাঘাত’ বলে আখ্যায়িত করেন আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ বলেন, আত্মরক্ষায় পাল্টা জবাব দেওয়ার মধ্য দিয়ে হামলার সমাপ্তি টেনেছে ইরান। তাঁরা আর যুদ্ধ বা উত্তেজনা চান না।

ট্রাম্প নিশ্চিত করেন, ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘আমি যতক্ষণ প্রেসিডেন্ট আছি, ইরান কখনো পারমাণবিক অস্ত্র রাখার অনুমতি পাবে না। যারা শান্তি চায়, তাদের আলিঙ্গন করতে প্রস্তুত যুক্তরাষ্ট্র।’ তিনি ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে করা পরমাণু চুক্তি থেকে জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ অন্যদের সরে যাওয়ার আহ্বান জানান।
উল্লেখ্য, ইরান চুক্তি ভঙ্গ করে ইউরেনিয়াম উৎপাদন করছে, অজুহাত তুলে ২০১৮ সালে এ চুক্তি থেকে সরে যায় যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এই চুক্তি সই করা দেশের মধ্যে চীন ও রাশিয়াও রয়েছে। এর আগে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চুক্তি সই করা দেশগুলোকে একাধিকবার আহ্বান করেও সাড়া পায়নি ইরান।

ইরানের রাজধানী তেহরানে ইউক্রেনের যাত্রীবাহী বিমানটি উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পর বিধ্বস্ত হলে এর ১৭৬ আরোহীর সবাই নিহত হন। ওই বিমানে কানাডা ও সুইডেনেরও নাগরিকেরা ছিলেন।

ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে বলেন, জেনারেল কাশেম সোলাইমানি হত্যার প্রতিশোধ প্রমাণ করে, যুক্তরাষ্ট্রের মোকাবিলায় ইরান পিছপা হয় না।

ইরানে বিধ্বস্ত ইউক্রেনের যাত্রীবাহী বিমান। ছবি: এএফপি
ইরানে বিধ্বস্ত ইউক্রেনের যাত্রীবাহী বিমান। ছবি: এএফপি
মধ্যরাতে ইরাকের রাজধানী বাগদাদের সংরক্ষিত গ্রিন জোনে দুটি রকেট হামলা হয়েছে। স্থানীয় সময় বুধবার গভীর রাতে কঠোর নিরাপত্তায় সুরক্ষিত এই গ্রিন জোনে রকেট হামলা চালানো হয়। বাগদাদের কেন্দ্রে অবস্থিত গ্রিন জোনে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, পার্লামেন্ট এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী দেশের দূতাবাস রয়েছে। তবে হামলায় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

৯ জানুয়ারি, বৃহস্পতিবার: স্থানীয় সময় ৯ জানুয়ারি কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেন, একাধিক সূত্র থেকে তিনি গোয়েন্দা তথ্য পেয়েছেন যে ইউক্রেনের বিমানটি ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে বিধ্বস্ত হয়েছে। তবে সেটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে করা না-ও হতে পারে।
প্রায় একই সুরে কথা বলেছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন।
এই পশ্চিমা নেতাদের ধারণা, সম্ভবত ভুল করে উড়োজাহাজটিতে আঘাত করা হয়েছিল।

কানাডা ও যুক্তরাজ্যের নেতারা উড়োজাহাজটি বিধ্বস্তের ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করেছেন।

কেরমান শহরে সোলাইমানির মরদেহ বহনকারী গাড়ি ঘিরে মানুষের ঢল। ছবি: এএফপি
কেরমান শহরে সোলাইমানির মরদেহ বহনকারী গাড়ি ঘিরে মানুষের ঢল। ছবি: এএফপি
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে উড়োজাহাজ ভূপাতিত হওয়া নিয়ে পশ্চিমা নেতাদের সন্দেহ নাকচ করে দিয়েছে তেহরান।

দুর্ঘটনা তদন্তে অংশ নিতে ইউক্রেনের প্রায় ৫০ জন সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ দল ইরান গেছে। ইউক্রেন জানিয়েছে, ক্ষেপণাস্ত্র হামলার সঙ্গে উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার কোনো যোগসূত্র আছে কি না, তা তদন্ত করতে চায় তারা।

সূত্র: বিবিসি, সিএনএন, রয়টার্স, ডয়চে ভেলে, এএফপি, ইরনা

Post a Comment

0 Comments